মো. শাহীন আলম, সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি::সুনামগঞ্জের কাঠইর থেকে জামালগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত জামালগঞ্জ-জামলাবাজ-নোয়াগাঁও বাজার এবং জামালগঞ্জ – মান্নানঘাট – সেলিমগঞ্জ – গাগলাজুর ও দক্ষিণ কামলাবাজ – নয়াহালট সড়কপথের বেহাল দশায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন সুনামগঞ্জ সদর, শান্তিগঞ্জ,জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, মোহনগঞ্জ নেত্রকোনা, ময়মনসিংহসহ কয়েকটি উপজেলার কয়েক লক্ষাধিক মানুষ এই রাস্তা দিয়ে সুনামগঞ্জ ও সিলেট বিভাগীয় শহরে যাতায়াত করেন। সড়কজুড়ে ভাঙাচোরা অবস্থা, খানাখন্দ, গর্ত, এবং ইট সলিং সরে যাওয়ায় ছোট-বড় যানবাহন চলাচলে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। গত ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যায় সড়কপথ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর নামমাত্র সংস্কার করা হলেও বর্তমানে রাস্তাগুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সুনামগঞ্জের সদর উপজেলার শাখাইতি মাদ্রাসা পয়েন্ট থেকে জামালগঞ্জ উপজেলার নোয়াগাঁও বাজার, জামলাবাজ ও জামালগঞ্জ উপজেলা শহরের নয়াহালট থেকে শুরু করে চানপুর ব্রীজ – মান্নানঘাট -সেলিমগঞ্জ-আলিপুর-গজারিয়া-গাগলাজুর পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি স্থানে ভাঙা গর্তে ভরা রাস্তায় যাত্রীদের চলাচল অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। চানপুর ব্রিজের এপ্রোচ ভেঙে বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। অসুস্থ, শিশু, অন্তস্বত্ত্বা মহিলা ও বৃদ্ধদের জন্য এই পথে চলাচল যেন এক দুঃস্বপ্ন।
গজারিয়া গ্রামের গাড়ি চালক মো. মাশুল মিয়া বলেন, “জামালগঞ্জ থেকে গজারিয়া পর্যন্ত সড়কটি বর্তমানে খুবই দুরবস্থায় পড়েছে। রামপুর, সংবাদপুর, চানপুর, নয়াহালটসহ বিভিন্ন স্থানে সড়কে ভাঙাচোরা, গর্ত ও খানাখন্দ সৃষ্টি হয়েছে। অনেক জায়গায় গার্ড ওয়াল ভেঙে গেছে। বিশেষ করে চানপুর ব্রীজের এপ্রোচ অংশটি ধসে গিয়ে মাটি সরে গেছে, ফলে সেখানে একটি বিশাল গর্ত তৈরি হয়েছে। যে কোন সময় ঘটতে পারে দূর্ঘটনা।
এই সড়কে চলাচল করতে গিয়ে আমরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছি। সাধারণ যাত্রীরা তো কোনোভাবে যাতায়াত করতে পারলেও অসুস্থ মানুষ, ডেলিভারী রোগী,বৃদ্ধ এবং শিশুদের নিয়ে চলাফেরা করা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
অনেক আগে থেকেই জামালগঞ্জ – গাগলাজুর সড়কটির এই সমস্যা চলছে। রাস্তার এই দুরবস্থার কারণে আমাদের গাড়িগুলো দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। একটি গাড়ি এক থেকে দেড় বছরও ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারি না। “যদি এই সড়কটি দ্রুত সংস্কার করা হয়, তাহলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ অনেক উপকৃত হবে।”
একই গ্রামের মোটর সাইকেল চালক পলাশ মিয়া বলেন, “আমাদের এই রাস্তাটি অনেকদিন ধরেই ভাঙাচোরা অবস্থায় রয়েছে। প্রতিদিনই খানাখন্দ ও গর্তের পরিমাণ বাড়ছে। এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে, সড়কে মোটরসাইকেলের চাকা রাখার মতো জায়গাও নেই। ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে, আর আমরা চরম ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চালাতে বাধ্য হচ্ছি। অসুস্থ ও বৃদ্ধ মানুষেরা এখন এই রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে পারেন না। তাদের অনেক সময় নৌকায় যাতায়াত করতে হয়, যা খুব কষ্টসাধ্য। তাই দ্রুত এই রাস্তাটির সংস্কার অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।”
চানপুর গ্রামের বাসিন্দা আজমান আলী একজন পেশাদার মোটরসাইকেল চালক। ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে তিনি সংসার চালান। তার মতো এই এলাকায় আরও শত শত মোটরসাইকেল, অটোরিকশা ও সিএনজি চালক রয়েছেন, যারা প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সড়কে চলাচল করেন।
আজমান আলী জানান, “রাস্তার বেহাল অবস্থা আমাদের প্রতিদিনের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। সড়কে অসংখ্য গর্ত, ভাঙাচোরা অংশ ও ইটের কারণে গাড়ি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে, প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। কেউ আহত হচ্ছে, কেউ পঙ্গু হচ্ছে, আবার অনেকেই প্রাণ হারাচ্ছেন।”
বন্যার পরে সড়কের কিছু ভাঙা জায়গায় ইট দিয়ে নামমাত্র সংস্কার করা হয়েছিল। তবে ব্যবহৃত ইটগুলো ইতোমধ্যেই সরে গিয়ে আরও বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। নতুন করে গর্ত তৈরি হয়েছে, কোথাও কোথাও গাড়ির চাকা ঘোরানোর মতো জায়গাও নেই। চালকদের নিয়ন্ত্রণ হারানোর ফলে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে।
জামালগঞ্জের মান্নানঘাট থেকে রিজার্ভ যাত্রী নিয়ে সুনামগঞ্জে আসছিলেন সিএনজি চালক রফিক মিয়া। যাত্রাপথে অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “গজারিয়া থেকে সেলিমগঞ্জ হয়ে মান্নানঘাট ও জামালগঞ্জ সদর পর্যন্ত সড়কের অবস্থা সম্পূর্ণরূপে পাল্টে গেছে। সড়ক ভেঙে ভেঙে এতটাই সরু হয়ে গেছে যে, এখন তা গাড়ি চলাচলের একেবারেই অনুপযোগী।”তিনি আরও জানান, প্রতিনিয়ত সীমাহীন ঝুঁকি নিয়ে তাদের চলাচল করতে হয়। একটু অসাবধান হলেই ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। যাত্রীদের দুর্ভোগেরও যেন কোনো শেষ নেই।
চালক রফিক মিয়া বলেন, “এই সড়কের বেহাল দশা নতুন নয় বছরের পর বছর ধরে এমনই চলছে। আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। অনতিবিলম্বে সড়কটি সংস্কার করে জনসাধারণের চলাচলের উপযোগী করা হোক।”
সিলেট জজ কোর্টের আইনজীবী এবং বর্তমানে এপিপি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এডভোকেট শফিকুল ইসলাম সবুজ এই রুটে নিয়মিত যাতায়াত করেন। তিনি বলেন, “আমি প্রায়ই সিলেট থেকে গ্রামের বাড়ি মোহনগঞ্জ যাই। জামালগঞ্জ হয়ে ধর্মপাশা রুটে যেতে হয় আমাকে। কিন্তু শাখাইতি মাদ্রাসা পয়েন্ট থেকে শুরু করে নোয়াগাঁও বাজার হয়ে জামালগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তার যে অবস্থা-তা বর্ণনাতীত। অসংখ্য গর্তে ভরা এই রাস্তায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলতে হয়। বিশেষ করে মন্নানঘাট থেকে জামালগঞ্জ সড়কটি সবচেয়ে বিপজ্জনক। অনেক জায়গায় তো মোটরসাইকেলের এক চাকা রাখার জায়গাও নেই।”
এই সড়কপথ দিয়ে প্রতিনিয়ত চলাচল করেন ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ জেলার বহু পেশাজীবী মানুষ।
মোহনগঞ্জ ও ধর্মপাশা হয়ে নৌপথে মান্নানঘাট পৌঁছান যাত্রীরা। সেখান থেকে মোটরসাইকেল, সিএনজি, লেগুনায় চড়ে জামালগঞ্জ হয়ে সাচনা বাজার হয়ে সুনামগঞ্জে যান। কেউ কেউ আবার দিরাই রাস্তা হয়ে সিলেটও যাতায়াত করেন।
তিনি আরও বলেন, “আমরা আশাবাদী, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত ব্যবস্থা নেবে এবং এ গুরুত্বপূর্ণ সড়কটির সংস্কার কাজ শুরু করবে। এতে শুধু সুনামগঞ্জ নয়, আশপাশের জেলার কর্মজীবী মানুষদের দুর্ভোগ অনেকটাই লাঘব হবে।”
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, সড়কগুলোতে বন্যার পর থেকে অবস্থা আরও নাজুক হয়ে উঠেছে বলে দীর্ঘদিন ধরে কোটি টাকার কাজ হলেও পরিকল্পনার অভাব, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে রাস্তাগুলো টেকসই হয়নি। প্রতি বছর সরকারের লাখ লাখ টাকা অপচয় হচ্ছে অথচ সমস্যার কোনো সমাধান হচ্ছে না।
জামালগঞ্জ উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী মো. ছানোয়ার হোসেন জানান, জামালগঞ্জ – জয়নগর পয়েন্ট – কাঠইর পর্যন্ত ১১.৩ কিলোমিটার সড়কটি বর্তমানে চরম বেহাল অবস্থায় রয়েছে। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন পথচারী ও যানবাহনচালকরা। সড়কটির সংস্কারের দাবিতে এলাকাবাসী ইতোমধ্যে মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করেছেন।
তিনি বলেন, “আমি এ বিষয়ে চীফ স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি এবং তিনি আমাকে আশ্বস্থ করেছেন যে, ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে ‘জিওবি মেইনটেন্যান্স’ প্রোগ্রামের আওতায় সড়কটির সংস্কার কাজ সম্পন্ন করা হবে।”প্রকৌশলী ছানোয়ার হোসেন আরও জানান, জামালগঞ্জ – সেলিমগঞ্জ- মান্নানঘাট – আলিপুর – গাগলাজুর পর্যন্ত দীর্ঘ সড়কটিতেও প্রায় এক দশক ধরে কোনো সংস্কার হয়নি। এই রাস্তাটিরও সংস্কারের জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যেই অনুমোদন পাওয়া যাবে এবং এরপর টেন্ডার আহ্বানের মাধ্যমে কাজ শুরু হবে।
এছাড়াও তিনি উল্লেখ করেন, দক্ষিণ কামলাবাজ – নয়াহালট সড়কে একটি ব্রীজ নির্মাণ জরুরি হয়ে পড়েছে। এই রাস্তাটি ‘হিলিপ প্রকল্প’ এর আওতায় ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে সংস্কারের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, এটিও একই অর্থবছরে অনুমোদন পাবে এবং কাজ শুরু হবে।
এলাকাবাসীর প্রত্যাশা, কর্তৃপক্ষ দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং জামালগঞ্জবাসীসহ আশপাশ জেলার কর্মজীবী মানুষের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ অবসান হবে।